ভূমিকম্পের আড়ালে কি গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা চলছে?


 ভূমিকম্পের আড়ালে কি গোপন পারমাণবিক পরীক্ষার আসর বসছে? — সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এল এমন উদ্বেগজনক আশঙ্কা।


লোস অ্যালামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সিসমোলজিস্টদের একটি নতুন পর্যালোচনা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কিছু ভূমিকম্প আসলে গোপনে চালানো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক বিস্ফোরণের ছদ্মবেশ হতে পারে।


জোশুয়া কারমাইকেল-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা Bulletin of the Seismological Society of America পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, প্রাকৃতিক ভূমিকম্প এবং গোপন পারমাণবিক বিস্ফোরণের সিসমিক তরঙ্গের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে যে সিসমিক সংকেত তৈরি হয়, তা অনেকটা প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের মতোই। তবে সাম্প্রতিক কিছু উন্নত সিসমিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি, বিশেষত কম্প্রেশনাল (P) তরঙ্গ ও শিয়ার (S) তরঙ্গের অনুপাত নিরীক্ষণ করে, এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সাধারণত বিস্ফোরণ ঘটলে ভূমিকম্পের তুলনায় বেশি পরিমাণে P-ওয়েভ তৈরি হয়।

জোশুয়া কারমাইকেল ও তাঁর সহকর্মীরা তাদের বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, বর্তমানে সবচেয়ে উন্নত সংকেত সনাক্তকারী প্রযুক্তি ১.৭ টন ওজনের একটি ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণকে ৯৭% সফলতায় চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেও, যদি সেই বিস্ফোরণের সংকেত কাছাকাছি সময়ে (প্রায় ১০০ সেকেন্ডের মধ্যে) এবং প্রায় ২৫০ কিমি দূরত্বে হওয়া কোনো ভূমিকম্পের তরঙ্গের সাথে মিশে যায়, তবে শনাক্তকরণের হার কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩৭%-এ।


কারমাইকেল বলেন, “যখন বিস্ফোরণ ও ভূমিকম্পের তরঙ্গ একত্রে মিশে যায়, তখন আমাদের সবচেয়ে সংবেদনশীল ডিজিটাল সংকেত সনাক্তকারীর পক্ষেও সেই বিস্ফোরণ নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।”

এই নতুন তথ্য পূর্বের ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ২০১২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভূমিকম্পের সংকেত কখনো বিস্ফোরণের সংকেতকে ঢেকে দিতে পারে না। এখন মনে করা হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের সংকেতের আড়ালে বিস্ফোরণের চিহ্ন ঢাকা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের কাছে এটি একটি গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


উত্তর কোরিয়ার প্রসঙ্গে কারমাইকেল বলেন, গত ২০ বছরে দেশটি ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ওই অঞ্চলগুলিতে সিসমিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দেখা গেছে, “পরীক্ষা-স্থলের আশপাশে আমরা যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুদ্র-মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছে।”

কারমাইকেল আরও যোগ করেন, নতুন বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, “যে কোনো ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে ব্যাকগ্রাউন্ড সিসমিকিটি বিস্ফোরণের সংকেত শনাক্তের সম্ভাবনাকে পরিমাপযোগ্য মাত্রায় এবং উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে।”


গবেষকেরা আরও লক্ষ্য করেছেন, একটানা ভূমিকম্প বা আফটারশক (পরবর্তী কম্পন) প্রবাহের সংকেতও একইভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সনাক্তকরণের হার ৯২% থেকে নেমে দাঁড়ায় মাত্র ১৬%-এ।

কারমাইকেল বলেন, “এতে হয়তো বোঝা যাচ্ছে যে, ভূমিকম্পের ঝাঁক বা আফটারশক প্রবাহের সময় যে ক্ষুদ্র মাত্রার ভূমিকম্পগুলি ঘটে, আমরা সেগুলিকে অনেকটাই কম গণনা করে থাকি। অর্থাৎ, এ ধরনের ঘটনাগুলির প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আমরা মারাত্মকভাবে কম করে হিসাব করি।”


তবে বিস্ফোরণ আড়াল হওয়ার বিষয়টি যাচাই করা এতদিন কঠিন ছিল, কারণ বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক বিস্ফোরণের নমুনা বা পাশাপাশি বিস্ফোরণ ও প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের যৌথ ডেটাসেট পাওয়া খুবই বিরল।


/এনডিটিভি